সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর রাতটি ছিল এক কথায় মহাকাব্যিক। চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়াল মাদ্রিদের এমন ঘুরে দাঁড়ানো পারফরম্যান্স ফুটবল বিশ্বে নতুন করে আলোড়ন তুলেছে। প্রথমার্ধে ২-০ গোলে পিছিয়ে যাওয়ার পরও, দ্বিতীয়ার্ধে দলের ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা যেন রিয়ালের ‘ডিএনএ’-তেই লেখা। আর এই ম্যাচে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছেন ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড ভিনিসিয়ুস জুনিয়র। এক কথায় বলতে গেলে, তিনি যেন জ্বলে উঠেছিলেন মাঠে।
প্রথমার্ধের শেষে রিয়াল সমর্থকদের মুখে ছিল হতাশার ছাপ। ২-০ ব্যবধানে পিছিয়ে থাকা কোনো দলের পক্ষে ফিরে আসা সবসময়ই কঠিন। কিন্তু রিয়াল মাদ্রিদ সেই দল, যারা বারবার অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। বিরতি থেকে ফিরে এসে রিয়াল যেন পুরোপুরি ভিন্ন একটি দল। বিশেষ করে ভিনিসিয়ুস জুনিয়র একাই পুরো ম্যাচের ভাগ্য বদলে দেন। দ্বিতীয়ার্ধের ৩১ মিনিটের মধ্যে তিনি হ্যাটট্রিক করেন, যা ছিল চমকপ্রদ। তাঁর দ্বিতীয় গোলটি বিশেষভাবে নজর কেড়েছে। ৮৬ মিনিটে যখন ভিনি নিজের অর্ধ থেকে বল পান, তখন তিনি প্রতিপক্ষের গোলপোস্ট থেকে প্রায় ৮০ মিটার দূরে ছিলেন। তারপর যা হলো, তা যেন এক অলৌকিক দৃশ্য। ডর্টমুন্ডের খেলোয়াড়দের একের পর এক পেছনে ফেলে, বল নিয়ে তিনি ৭০ মিটার অতিক্রম করেন মাত্র ৯ টাচে। ১০ম টাচে গোল, যা ফুটবল ভক্তদের মুগ্ধ করেছে।
ভিনির এই অসাধারণ পারফরম্যান্সের পর বার্নাব্যুর গ্যালারি উত্তাল হয়ে ওঠে। খেলার শেষ বাঁশি বাজার পরও সমর্থকরা থামেনি, বারবার তাঁর নাম ধরে ‘ব্যালন ডি’অর’ জয়ের দাবি জানাতে থাকে। তাদের মতে, এমন দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর ভিনিসিয়ুসই ব্যালন ডি’অর জয়ের যোগ্য। এক সময়ের রিয়াল তারকা করিম বেনজেমাও ইনস্টাগ্রামে ভিনির প্রশংসা করে ‘ব্যালন ডি’অর’ শব্দটি লেখেন এবং সাথে আগুনের ইমোজি দেন, যা ভিনির খেলার উত্তেজনাকে প্রতিফলিত করে। ভিনির পারফরম্যান্সকে এভাবে প্রশংসা করা থেকে বোঝা যায়, তাঁর খেলায় কতটা আগুন লেগেছিল।
তবে ভিনিসিয়ুসের সতীর্থ লুকাস ভাসকেজও মজার ছলে বলেন, "আজ রাতে প্রতিটি গোলের পর ভিনিই ছিল ব্যালন ডি’অর।" আর তাঁর কোচ কার্লো আনচেলত্তি বলেন, "আজকের রাতের পারফরম্যান্সের জন্য নয়, বরং গত মৌসুমের অসাধারণ খেলাগুলোর জন্য ভিনিসিয়ুস এই বছরের ব্যালন ডি’অর জিতবে। তবে আজকের ৩ গোল তাঁকে আগামী বছরের ব্যালন ডি’অর জেতার পথে এগিয়ে দেবে।"
এমন পারফরম্যান্স সবসময় দেখা যায় না। বিশেষত ভিনিসিয়ুসের তৃতীয় গোলটিও ছিল অতুলনীয়। বল নিয়ে ডর্টমুন্ডের তিনজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে তাঁর সেই বডি ফেইন্ট ও বুলেট গতির শট—এতটাই নিখুঁত ছিল যে, রিয়ালের কিংবদন্তি এমিলিও বুত্রাগুয়েনো ভিনির খেলাকে পেলের সাথে তুলনা করেছেন। বুত্রাগুয়েনো বলেন, "তাঁর বডি ফেইন্ট ও গতির সমন্বয় আমাকে পেলেকে মনে করিয়ে দেয়।"
এই ম্যাচের পর ভিনিসিয়ুস তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়েও কথা বলেন। তিনি জানান, মাদ্রিদে চিরকাল থাকতে চান এবং রিয়াল মাদ্রিদের সমর্থকদের স্লোগানে তাঁর স্বপ্নগুলো পূর্ণতা পায়। তিনি আরও বলেন, "আমার বয়স ২৪ বছর, আমি আরও অনেক গোল করতে চাই এবং ক্লাবকে আরও অনেক কিছু ফিরিয়ে দিতে চাই।"
ভিনিসিয়ুসের ক্যারিয়ারে এটি তাঁর তৃতীয় হ্যাটট্রিক, আর উয়েফার তথ্য অনুযায়ী, চ্যাম্পিয়নস লিগে ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড় হিসেবে এটি ২২তম হ্যাটট্রিক। তবে শুধুমাত্র এই পরিসংখ্যান দিয়ে ভিনির অসাধারণ পারফরম্যান্সের সঠিক চিত্র তুলে ধরা সম্ভব নয়। মাঠে তাঁর যে জাদুকরী ফুটবল দেখিয়েছে, তা বহুদিন ধরে ফুটবলপ্রেমীদের মনে থাকবে।
রিয়াল মাদ্রিদের সাবেক খেলোয়াড় রিও ফার্ডিনান্ডও ভিনিসিয়ুসের এই পারফরম্যান্স দেখে বেশ উচ্ছ্বসিত ছিলেন। তিনি মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে মাইক্রোফোন হাতে ভিনির প্রতি বারবার ‘ব্যালন ডি’অর’ শব্দটি উচ্চারণ করেন। তাঁর মতে, ভিনির ব্যাগে ইতিমধ্যে ব্যালন ডি’অর ঢুকে গেছে। ফার্ডিনান্ডের এই উচ্ছ্বাস ভিনিসিয়ুসের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের একটি নিখুঁত প্রতিফলন।
ম্যাচটি দেখার পর যদি কেউ এই অনুভূতিতে ডুবে যায়, তাহলে তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না। ফুটবলের মায়াজালে অনেক রাতেই এমন ঘটে, যখন কোনো খেলোয়াড় পুরো ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। আর সেই রাতটি ছিল ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের।
Post a Comment