রদ্রি: ম্যান সিটির হৃদয়, স্পেনের আত্মা, এবং ব্যালন ডি’অর জয়ী।


রদ্রির ফুটবল ক্যারিয়ার যেন এক অসাধারণ গল্প। একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে তাঁর খেলা মাঠে যেন এক শান্ত অর্কেস্ট্রা কন্ডাক্টরের মতো—একটি ক্রীড়ামঞ্চ যেখানে তিনি প্রতিটি খেলোয়াড়ের সাথে তাল মিলিয়ে খেলেন, তৈরি করেন সুরের মিশ্রণ। এ যেন একটি নিখুঁতভাবে গাঁথা নকশিকাঁথার মতো, যেখানে প্রতিটি পাসের সঙ্গে সৃষ্ট হয় নতুন কিছু। তাঁর পায়ের কাজ কখনো সুরেলা, কখনো ছন্দময়, আর মাঝে মাঝে এমনই বুদ্ধিমত্তার ছাপ রাখে, যে তা ফুটবলপ্রেমীদের মুগ্ধ করে।

প্যারিসের থিয়েটার দু শাতলেতে যখন রদ্রি ব্যালন ডি'অরের মঞ্চে উঠলেন, সবাই তখন তার দিকে তাকিয়ে ছিল। একটি ক্রাচে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে তিনি যখন উঠে দাঁড়ালেন, তখন স্পেনের প্রতিটি কোণ থেকে যেন এক অদৃশ্য হাসির রেশ তাঁর দিকে পৌঁছে গিয়েছিল। এই মুহূর্তের মূল্য বোঝা যায় যখন আমরা উপলব্ধি করি যে, ৬৪ বছর পর কোনো স্প্যানিশ খেলোয়াড় আবার এই সম্মান অর্জন করল। রদ্রির এই মুহূর্তটি কেবল স্পেনের নয়, ছড়িয়ে পড়েছিল ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার সিটির নীল আকাশে। তাদের ফুটবল ক্লাব কখনো ব্যালন ডি'অরের মতো বৈশ্বিক ট্রফির স্বাদ পায়নি। আজ সে ঘাটতিটা মেটালেন রদ্রি, যিনি সিটির হয়ে এই প্রথম সম্মান অর্জন করলেন এবং ইতিহাসে নিজের জায়গা করে নিলেন।



রদ্রির এই জয়ে লুইস সুয়ারেজ থাকলে হয়তো তিনিও গর্ব অনুভব করতেন। সুয়ারেজ ছিলেন প্রথম স্প্যানিশ খেলোয়াড়, যিনি ১৯৬০ সালে ব্যালন ডি’অর জিতেছিলেন। তাঁর হাত ধরে স্পেন প্রথম ব্যালন ডি’অর জয় করে। কিন্তু ২০২৩ সালে এসে রদ্রি যখন একই সম্মান অর্জন করলেন, তখন সুয়ারেজ তা সরাসরি দেখতে পারেননি। তবে হয়তো অন্যলোকে থাকলেও তাঁর এই অর্জন সুয়ারেজের চোখ এড়িয়ে যায়নি। প্যারিসের জমকালো থিয়েটারে রদ্রি যখন তাঁর স্বীকৃতি নিচ্ছিলেন, তখন গ্যালারিতে থাকা স্পেনের কোচ লুইস দে লা ফুয়েন্তে হয়তো নিজেও উচ্ছ্বসিত ছিলেন। ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের পর তিনি বলেছিলেন, ‘ব্যালন ডি’অর এখনই রদ্রিকে দিয়ে দেওয়া হোক।’ আর আজ, তাঁর সে কথাই যেন সত্যি হলো।


অন্যদিকে, অনেকেই ভেবেছিল এবার এই ট্রফি যাবে ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড ভিনিসিয়ুসের হাতে। তাঁর দ্রুততা, শৈলী, এবং গোল করার ক্ষমতা সকলেই মুগ্ধ। ব্রাজিলিয়ান সমর্থকেরা আশা করেছিল, এবার হয়তো তাঁদের ঘরের ছেলে এই স্বীকৃতি পাবে। তবে সাংবাদিকদের ভোটে রদ্রির পক্ষেই বেশি সমর্থন আসে। ভোটের ফলে যখন রদ্রিকে ব্যালন ডি’অর দেওয়া হয়, তখন অনেকেই হতবাক হয়। এমনকি, থিয়েরি অঁরির মতো কিংবদন্তিরা আগেই বলেছিলেন, মিডফিল্ডারদের অনেকেই ভুলে যায়, অথচ তাঁরা দলের প্রাণভোমরা। তবে ভোটে রদ্রির জয় সেই ধারণাটাকে ভুল প্রমাণ করেছে।

গত মৌসুমে রদ্রির প্রভাব এমন ছিল যে তা অস্বীকার করা কঠিন। প্রতি ম্যাচে তাঁর মাঠের উপস্থিতি ছিল নির্ভরতার প্রতীক। প্রতিপক্ষের আক্রমণ রুখে দেওয়া থেকে শুরু করে নিজ দলের আক্রমণের পথ তৈরি, প্রতিটি ধাপে তিনি ছিলেন নির্ভুল। প্রতিবারই তিনি যেন নিজের খেলাকে উন্নত করেছেন, যা দেখে ম্যানচেস্টার সিটি ও স্পেনের দর্শকেরা প্রশংসায় মুখর। গত মৌসুমে সিটি শুধু লিগেই নয়, ইউরোপিয়ান সুপার কাপ এবং ক্লাব বিশ্বকাপেও জয়লাভ করে। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে তাঁর অবদানের পরিসংখ্যানও বিস্ময়কর—মোট ১৭ গোল এবং অসংখ্য পাসে সাহায্য করেছেন, যেগুলো সরাসরি গোলের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। তাঁর ‘কি পাস’ ছিল শতাধিক, যা একটি মিডফিল্ডারের জন্য দারুণ অর্জন।



এই সম্মান পাওয়ার পর মঞ্চে দাঁড়িয়ে রদ্রি তাঁর জীবনের বিশেষ মানুষকে ধন্যবাদ জানান। তাঁর প্রেমিকা লরা সামনে বসে ছিলেন, এবং রদ্রি বলেন, তাঁদের অষ্টম বার্ষিকী উপলক্ষে এই অর্জনটি তাঁর জন্য বিশেষ কিছু। এই সুন্দর মুহূর্তে প্রেমিকার সাথে এই গর্ব ভাগাভাগি করতে পেরে রদ্রি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। লরার মুখে সেই গর্ব এবং আনন্দের মিষ্টি হাসি যেন সব কিছুকে আরও স্মরণীয় করে তোলে। সেই মুহূর্ত রদ্রির জন্য ছিল নিখুঁত, অবিশ্বাস্য।


রদ্রির জীবনের ধাঁচটা বরাবরই সাদামাটা। তাঁর কথাতেই বোঝা যায়, তিনি সবসময় নিজের কাজটা নিভৃতে করতে ভালোবাসেন। তিনি মাঠের বাইরে নিজেকে সাধারণ মানুষ হিসেবে পরিচয় দেন এবং সমাজের চোখে সেলিব্রিটির মতো না থেকেও তিনি যে ফুটবলের শীর্ষ পর্যায়ে স্বীকৃতি পেয়েছেন, তা তাঁকে আলাদা মর্যাদা দেয়। তাঁর এই অনাড়ম্বর, সাদাসিধে জীবনযাপন তাঁকে ফুটবলপ্রেমীদের কাছে আরও প্রিয় করে তুলেছে।


রদ্রির ফুটবল জীবনের যাত্রা এখানেই শেষ নয়। আরও অনেক চ্যালেঞ্জ তাঁর সামনে অপেক্ষা করছে, এবং ফুটবল বিশ্বে তাঁর অবদান শুধু ক্লাব বা দেশের মাঠেই নয়, প্রতিটি ফুটবলপ্রেমীর হৃদয়ে থেকে যাবে। তাঁর সেই নিভৃতে খেলে যাওয়ার মনোভাব ও অবিচল নিষ্ঠাই তাঁকে এই স্বীকৃতি এনে দিয়েছে এবং হয়তো ভবিষ্যতে আরও অনেক গৌরবময় অধ্যায় তৈরি করবে।

Post a Comment

Previous Post Next Post